পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের সক্ষমতা উন্নীতকরণ জরুরি।
— নাইম ইসলাম নিবির
সিলেট ও সুনামগঞ্জে হঠাৎ করেই বন্যার প্রকোপ দৃশ্যায়িত হয়েছে। অঞ্চলগুলোতে বন্যার পানি প্রবল বেগে হানা দিয়েছে। হঠাৎ করে বন্যা পরিস্থিতি ঘটে যাওয়ায় স্থানীয় মানুষজন তেমন জোড়ালো প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারেনি। দুর্গত এলাকায় ভুক্তভোগী মানুষ ধারণাও করতে পারেনি যে, এতো অল্প সময়ের মধ্যে প্রচুর পানি ঢুকে গোটা সিলেট-সুনামগঞ্জকে একটা বিপন্ন এলাকায় পরিণত করে তুলবে। বৃষ্টি-বন্যার পানি যেমন সহসা সবাইকে অবাক করে ভাসিয়ে দিয়েছে, ঠিক তেমনই বিদ্যুতের সাবস্টেশনে পানি ঢুকে যাওয়ায় নিরাপত্তার কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিতে হয়েছে। বিদ্যুৎ না থাকায় ঘরে ঘরে ব্যবহূত মোবাইল ফোন চার্জের অভাবে সচল রাখা যায়নি। ফলে বিদ্যুৎ না থাকা ও মোবাইল ফোন সচল রাখতে না পারায় বিপদাপন্ন মানুষের সংকট আরও বেড়েছে। একটা ভয়ার্ত অবস্থা মানুষকে দিশাহীন করে তুলেছে। এই সংকটে মানুষকে উদ্ধার করা, নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নেওয়া, জীবনকে স্বাভাবিক করা বড় চ্যালেঞ্জ। খাদ্য, আশ্রয়, চিকিৎসার ব্যবস্থা করাই বড় কাজ।
যে কোনো বড় সংকটের মতো এবারও প্রাথমিক ধাক্কা উতরে সরকার, রাষ্ট্র, জনমানুষ অতীতের মতোই ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মানুষ দাঁড়াচ্ছে বন্যার্ত মানুষের পাশে। স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে সংকট কাটানোর জন্য নেওয়া হবে বহু রকম উদ্যোগ। কিন্তু যে প্রশ্নটি এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো এ রকম বড় বিপদ কেন ঘটল? কোনো প্রস্তুতিই বা আমরা নিতে পারলাম না কেন? কোনো পূর্বাভাসই বা দেওয়া গেল না কেন? তার চেয়েও বড় কথা উন্নয়ন কাজে, অবকাঠামো নির্মাণে আমাদের কোথাও কোনো গলদ হচ্ছে কিনা? নানা রকম বিশ্নেষণ উঠে আসছে। দেশ-বিদেশের বহু গবেষক নানাভাবে এই বিপদের কারণের ব্যাখ্যাও দিচ্ছেন। সেগুলো এখন আলোচনায় আসা, নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় আনা দরকার এসব বাস্তব ঘটনা ও কারণকে। কেননা, এই বন্যা যেসব দুর্গতির মুখে আমাদের ফেলল, সহসাই এ থেকে আমাদের রেহাই নেই।
অবাক হবার বিষয় যে, বন্যা আসতে না আসতেই পুরো সিলেট অঞ্চলের বিদ্যুৎ বিভাগের অসহায়ত্ব দেখে। বহু বছর ধরে আমরা বলে আসছিলাম, যে প্রক্রিয়ায় আমাদের গ্রামীণ বিদ্যুৎ ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, বিকশিত হচ্ছে, বিস্তৃতি নিচ্ছে; তা ক্রমেই এ ব্যবস্থাকে নাজুক করে তুলেছে। একটা পপুলিস্ট, প্রচারণাপ্রবণ, রাজনীতিদুষ্ট দর্শনকে আশ্রয় করে এগিয়ে চলা এই গ্রামীণ বিদ্যুৎ বিন্যাস যে কোনো দুর্যোগে তার নূন্যতম সেবা সচল রাখতে যে ব্যর্থ হবে- আমাদের সে আশঙ্কা এবার সত্য প্রমাণিত হলো। সিলেট অঞ্চলে পানি ঢুকতে না ঢুকতেই আক্রান্ত হয়েছে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের আওতাধীন বিতরণ সাবস্টেশনগুলো। সাবস্টেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এর লোকেশন হওয়া উচিত কারিগরিভাবে উপযুক্ত অবস্থানে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানগুলো যেহেতু দৃশ্যমান স্থাপনা। কাজেই এগুলোকে নিজের নির্বাচনী এলাকায় স্থাপন করার একটা চেষ্টা থাকে ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদদের। ফলে সেটা অনেক সময় কারিগরি উপযুক্ততা বা মান ঠিক না রেখেই করতে হয়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠান হিসেবে এই রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করার সক্ষমতা অর্জনের বদলে দিনে দিনে তা হারিয়েছে। অন্যদিকে পিডিবি বা পিজিসিবি তাদের সাবস্টেশন সবসময় একটু উঁচু ভূমিতে নির্মাণের সংস্কৃতি লালন করে। যাতে বন্যা বা বৃষ্টিজনিত দুর্ভোগেও সেটা সচল থাকে।
পল্লী বিদ্যুৎ সেটা খুব একটা বিবেচনায় নেয় না। শুধু তাই নয়; বিদ্যুৎ বিতরণ লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রেও পল্লী বিদ্যুতের কারিগরি মান, সামাজিক বিবেচনা খুব টেকসই ঘরানার নয়। যে কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ঘাটতি না থাকা সত্ত্বেও পল্লী বিদ্যুতের গ্রাহকরা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎসেবা কখনোই পান না। ফলে বন্যাপ্রবণ এলাকা তো বটেই; দেশের অন্যত্রও বিদ্যুতায়নের অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে আরও সতর্ক ও সুবিবেচনা আবশ্যক। কেননা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থাই আসলে আমাদের সব সেবা খাতের মূল চালিকাশক্তি। বিদ্যুতের সংকট হলে আমাদের টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা বিপন্ন হয়। মানসম্মত বিদ্যুৎ না পেলে স্বাস্থ্যসেবা খাত বিশেষ করে হাসপাতালের চিকিৎসাসেবা সচল রাখা; ওষুধ-ভ্যাকসিনসহ নানা রকম গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জাম সংরক্ষণ কঠিন হয়ে পড়ে। মোদ্দা কথা, চিকিৎসা ব্যবস্থার মূল অবকাঠামোই ভেঙে পড়ে। ফলে এদিকে নজর দেওয়াটা এখন জরুরি।
ইতোমধ্যে আমরা জেনে গেছি, সিলেটে বন্যার একটা বড় কারণ দেশের বাইরে থেকে আসা বৃষ্টির পানি। সে পানি আমাদের নদনদী ধারণ করতে পারছে না। অর্থাৎ আমাদের নদনদীর নাব্য নেই। নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। আমরা যেভাবে বড় বড় নদীতে সেতু স্থাপন করছি, তার নদীশাসনের একটা প্রভাব আমাদের নদী প্রবাহে থাকছে। হাওর এলাকার স্বাভাবিক গতির ওপর খোদকারি করে সড়ক নির্মাণ যে আমাদের সুবিবেচনা নয়- সেটা ক্রমেই প্রকট হতে শুরু করেছে। সুতরাং এটা এখন আর বলার অপেক্ষা রাখে না; প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবণতাকে বাধা দিয়ে মনুষ্যসৃষ্ট যে কোনো ছোট-বড় অবকাঠামোগত উন্নয়নেরই একটা বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। সেটাকে বিবেচনায় নিতেই হবে। আমাদের সব উন্নয়নকাজে পরিবেশগত প্রভাব বা প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি খুবই জোরালোভাবে বিবেচনা করতে হবে।
অন্যদিকে জলবায়ুর পরিবর্তনের যে প্রক্রিয়া আমরা দেখছি, সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে আমাদের সব সেবা খাতের অবকাঠামো ও প্রশাসনিক বিন্যাসকে রিডিজাইন করতে হবে। দুর্যোগে, বিপন্নতায় যেন সক্ষমতা ও নিরাপত্তার সঙ্গে সেবা খাত তার সেবা সচল রাখতে পারে, সেটা দেখতে হবে। কেননা, বন্যা-ঝড়সহ যে কোনো প্রাকৃতিক, পরিবেশগত বিপর্যয়ে বিপদাপন্ন মানুষের তো আগে দরকার তার প্রয়োজনীয় সেবা খাতের সুবিধাটা হাতের কাছে পাওয়া। পরিবেশকে আমরা বহুভাবে অগ্রাহ্য করেছি। পরিবেশের ওপর অত্যাচারও করেছি নানা নামে, নানা স্বার্থে। এখন পরিবেশ তার প্রতিশোধ নিচ্ছে। অন্যদিকে আমাদের উন্নয়ন চিন্তাও পরিবেশবান্ধব হয়ে ওঠেনি। সেখানেও মেরামতি দরকার। পরিবেশের সঙ্গে উন্নয়ন ভাবনারও একটা টেকসই, বাস্তবসম্মত সেতুবন্ধন অতিব প্রয়োজন।
নাইম ইসলাম নিবির : প্রধানমন্ত্রীর স্নেহধন্য রাজনীতিক ও কলাম লেখক
nayemulislamnayem148@gmail.com